ঢাকা,শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

কক্সবাজার এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়টি দূর্নীতির আখঁড়ায় পরিনত, ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না!

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: কক্সবাজার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডির) কার্যালয়টি দূর্নীতির আখঁড়ায় পরিনত হয়েছে। এখানে ঘাটে ঘাটে চাহিদা মোতাবেক উৎকোচ না দিলে ঠিকাদারদের কোন ফাইলে দস্তখত দেয়া হয় না। অফিসের প্রচলতি নিয়ম অনুযায়ী শতকরা ৩% ঘুষ না দিলে ঠিকাদারদের বিলের ফাইল আটকিয়ে মাসের পর মাস হয়রানী করা হয় বলে ওই অফিসের তালিকাভুক্ত নির্মাণ কাজে অংশ নেয়া ঠিকাদাররা অভিযোগ করেছেন। এছাড়া ই-জিপি টেন্ডারে অংশ নেয়া ঠিকাদারদের কার্যাদেশ প্রদানেও চরম অনিয়ম ও দূর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। বিশেষত: এল-টি-এম পদ্ধতিতে ওই দপ্তরের প্রচারিত দরপত্রে কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের লটারী সম্পন্ন হওয়ার পরও কাজ না পাওয়া ঠিকাদারদের কোটি কোটি টাকার পে-অর্ডার আটকিয়ে রেখে ব্যাংক কতৃপক্ষের কাজ থেকে গোপনে সুযোগ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ওই অফিসের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।
এতে করে কাজে অংশ নেওয়া ঠিকাদারদের ১৪%হারে পে-অর্ডারের বিপরিতে লাখ লাখ টাকার সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে ব্যাংক গুলোকে। দরপত্র আহবান করার পর নোটিফিকেশন অর্ডার দিতে মাসের পর মাস বিলম্ব করার কারণে নির্দিষ্ট সময়ে ঠিকাদাররা কাজে অগ্রগতি করতে পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে ওই অফিসে নির্বাহী প্রকৌশলী, সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী ও সহকারী প্রকৌশলীকে বারংবার অভিযোগ করার পরও ঠিকাদারদের হয়রানী বন্ধে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।
প্রতি বছর কক্সবাজার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয় থেকে শত কোটি টাকার বিবিধ উন্নয়ন মূলক কাজের দরপত্র আহবান করা হলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওয়ার্কঅর্ডার ইস্যু না করায় উন্নয়ন মূলক কাজে স্থবিরতা নেমে এসছে।
ভুক্তভোগী ঠিকাদারদের পক্ষ থেকে অভিযোগ অনা হয়েছে, ওই অফিসের দূর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে এখান থেকে বদলী করা না হলে সরকারী উন্নয়ন কর্মকান্ড গুলো ভেস্তে যাবে।
এ জেলার ৮ উপজেলার মধ্যে বৃহত্তম চকরিয়ায় সড়ক মেরামত ও নির্মাণকাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রকল্পের বাজেট মূল্যায়ন সঠিক না হওয়ার অভিযোগ তুলে ঠিকাদাররা দরপত্রে অংশ নিচ্ছেন না। আর সমস্যার সমাধান না করে এলজিইডি দরপত্র ডেকে সময়ক্ষেপণ করছে। এই কারণে বন্যা পরবর্তী গত সাত মাসে একটি সড়কেরও নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে পারেনি সরকারি প্রতিষ্ঠানটি। এই অবস্থায় উপজেলায় বন্যা বিধ্বস্ত সড়কগুলোর মেরামত ও নির্মাণ আগামী বর্ষার আগে সম্পন্ন হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এলাকাবাসী ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, কক্সবাজার ঘিরে সরকার যখন বিপুল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দ্রুত সম্পন্নের চেষ্টা করছে; সেই সময়ে এলজিইডির এই নেতিবাচক ভূমিকায় জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়নও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
বিষয়টি স্বীকার করে চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম বলেন, ‘গত বছর বন্যার সড়ক মেরামতকাজ এখনো সম্পন্ন করতে পারেনি এলজিইডি। বর্ষা আসতে সময় আছে কমাস; এর মধ্যে সম্পন্ন করতে না পারলে একবছর পিছিয়ে যাবে নির্মাণ ও মেরামতকাজ। এটি আমাদের জন্য বিব্রতকর ও দুর্ভাগ্যজনক।’ কোনো প্রতিষ্ঠানের গাফিলতির কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, উন্নয়নকাজ বন্ধ থাকবে এটা কখনোই মেনে নেওয়া হবে না বলেও মন্তব্য করেন জাফর আলম।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের জুনে চকরিয়া-পেকুয়া ভয়াবহ বন্যায় উপজেলার সঙ্গে সংযোগ সড়ক এবং ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ সংযোগ সড়কের অনেক অংশ লন্ডভন্ড হয়ে যায়। যার বেশির ভাগই এলজিইডি অধীন। এতগুলো সড়ক বিধ্বস্ত হওয়ার পরও চকরিয়ায় মাত্র ১০টি সড়ক প্রকল্প মেরামত কাজের অনুমোদন দেওয়া হয়। আর গত সাত মাসেও সেই ১০টি সড়কের একটিও এখন পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেনি এলজিইডি। অনেক সড়ক অনুমোদনের জন্য ফাইলবন্দি আছে, আবার অনেক সড়ক মেরামত প্রস্তাব তৈরি করাই হয়নি।
কাকারা ইউপি চেয়ারম্যান শওকত ওসমান বলেন, ‘গ্রামীণ বেশির ভাগ সড়কই এলজিইডির। শীতের এই মৌসুম হচ্ছে নির্মাণ ও মেরামত কাজের মূল সময়, চলে এপ্রিল পর্যন্ত। তাহলে কাজের সময় আছে মাত্র তিন মাস। এই সময়ের মধ্যে দরপত্র ডেকে ঠিকাদার নিয়োগ এবং কাজ শুরু করা কঠিন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার সঙ্গে কাকারা ইউনিয়নের বন্যাবিধ্বস্ত প্রধান সড়ক (বাদশাহটেক থেকে মাঝেরফাঁড়ি পর্যন্ত) ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে মেরামতকাজ প্রথম দফায় দরপত্র ডাকা হলেও সাড়া মেলেনি। এখন দ্বিতীয় দফায় গত ২৮ জানুয়ারি দরপত্র ডাকা হলে কেউ অংশ নেয়নি। আর বন্যাবিধ্বস্ত ডুলাহাজারা-মালুমঘাট আরএইচডি সড়ক ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণের জন্য দুদফায় দরপত্র ডাকা হলেও সাড়া মেলেনি। এখন তৃতীয়বার দরপত্র ডাকা হচ্ছে। আর চকরিয়ার মগবাজার-জেটি সড়ক মেরামতে চারবার দরপত্র ডাকা হলেও ঠিকাদার মেলেনি। এখন আবারও দরপত্র ডাকা হচ্ছে।
জানতে চাইলে চকরিয়া ঠিকাদার সমিতির আহ্বায়ক শফিকুল কাদের বলেন, ‘প্রকল্পের মূল্যায়ন সঠিকভাবে করা হচ্ছে না। দর এমনভাবে নির্ণয় করা হচ্ছে যেখানে কাজ করলে কোনো লাভ হবে না। তাহলে লোকসান দিয়ে কেন আমরা পুঁজি খাটাবো?’ তিনি বলেন, ‘নিয়মেই আছে কোনো প্রকল্পে দর পাঁচ শতাংশ কম-বেশি হবে। কিন্তু পাঁচ শতাংশ বেশি হলেই অনুমোদন মেলছে না। এর আগেও অনেকগুলো কাজে আমি লোকসান দিয়েছি। এই কারণে শুধু চকরিয়া নয় কক্সবাজারেও ঠিকাদাররা এলজিইডির কাজে অংশ নিচ্ছে না।’
এমনটি কেন হচ্ছে জানতে চাইলে চকরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী কমল কান্তি পাল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে এলজিইডি কক্সবাজার জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী ইফতেখার আলী বলেন, ‘‘নিয়মানুযায়ী লটারি পদ্ধতিতে দুবার ঠিকাদার পাওয়া না গেলে তৃতীয়বার ‘এনি এভাব’ হিসেবে দরপত্র আহ্বান করা হচ্ছে। প্রকল্প মূল্যায়ন সঠিক না হলে ৫ শতাংশ বেশি দর দিলে আমরা আগে বিবেচনা করিনি, এখন থেকে করব।’
চকরিয়ায় ১০টি প্রকল্পের মধ্যে কয়টি সড়কের কাজ শেষ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘একটি প্রকল্পের কাজ ৯২ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কোনোটির নির্মাণ কাজ চলছে। আবার কোনোটি দরপত্র পর্যায়ে রয়েছে।’ আগামী এপ্রিলের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করতে পারব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ছোট ছোট কাজ দুই-তিন মাসের বেশি লাগবে না।’

পাঠকের মতামত: